অধিকার হরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে উত্তাল কুষ্টিয়া ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন,নেতাদের বিরুদ্ধে সাধারণ শ্রকঠিন হুঁশিয়ারি।
কুষ্টিয়ার পরিবহন খাতের অন্যতম বৃহৎ সংগঠন ‘কুষ্টিয়া জেলা ট্রাক, ট্রাক্টর, কাভার্ডভ্যান,ট্যাংকলরী শ্রমিক ইউনিয়ন’ (রেজিঃ নং-খুলনা-১১১৮) এর অভ্যন্তরে তীব্র অসন্তোষ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। ইউনিয়নের সাধারণ শ্রমিকরা তাদের নির্বাচিত নেতাদের বিরুদ্ধে অধিকার হরণ, চরম অবহেলা এবং ব্যাপক দুর্নীতির মতো গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর মতো কঠিন সময়ে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কারণে খেটে খাওয়া মেহনতি শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ এখন ফুঁসে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতিবাজ নেতাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সাধারণ শ্রমিকরা।
কুষ্টিয়া জেলা ট্রাক,ট্রাক্টর,কাভার্ডভ্যান, ট্যাংকলরী (দাহ্য পদার্থ বহনকারী ব্যতীত) শ্রমিক ইউনিয়ন। কুষ্টিয়া জেলা ট্রাক ট্যাংকলরী ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন। রেজিস্ট্রেশন খুলনা-১১১৮।
অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশ সড়ক,পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। প্রধান কার্যালয় চেয়ারম্যান ভিলা, চৌড়হাস ফুলতলা, কুষ্টিয়া। এই ইউনিয়নের মূল উদ্দেশ্য হলো এর অন্তর্ভুক্ত হাজার হাজার ট্রাক, ট্রাক্টর ও কাভার্ডভ্যান চালক ও সহকারীদের পেশাগত স্বার্থরক্ষা,কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণ এবং যেকোনো দুর্ঘটনা বা বিপদাপদে তাদের ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু শ্রমিকদের অভিযোগ,ইউনিয়নের বর্তমান নেতৃত্ব এই উদ্দেশ্য থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সাধারণ শ্রমিকের সাথে কথা বলে তাদের অভিযোগগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ অভিযোগটি হলো কর্মরত অবস্থায় কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হলে ইউনিয়ন তার দায়িত্ব পালন করে না। চুক্তি অনুযায়ী, ইউনিয়নের কল্যাণ তহবিল থেকে দুর্ঘটনাগ্রস্ত শ্রমিক বা নিহত শ্রমিকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও,অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সহায়তা মেলে না। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সামান্যতম সাহায্য ছাড়াই ফিরতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিকরা। তারা বলেন,গাড়ির চাকা ঘুরলে নেতার পকেট ভরে, আর সেই চাকার তলায় পিষ্ট হয়ে আমরা মরলে আমাদের পরিবারের খবর কেউ রাখে না।
শ্রমিকদের অভিযোগ, প্রতিদিন তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন নামে চাঁদা আদায় করা হয়। এই চাঁদার টাকায় শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু সেই তহবিলের কোনো স্বচ্ছ হিসাব নেই। শ্রমিকদের কষ্টো র্জিত টাকায় নেতারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাড়াচ্ছেন। অথচ একজন সাধারণ শ্রমিকের বিপদে সেই তহবিল থেকে সাহায্য চাওয়া হলে ‘টাকা নেই’ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
ইউনিয়নের ভেতরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ সাধারণ শ্রমিকদের। তাদের মতে, নেতারা তাদের পছন্দের লোকদের নিয়েই ইউনিয়ন পরিচালনা করেন। সাধারণ শ্রমিকদের মতামতকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কেউ অন্যায় নিয়ে প্রতিবাদ করলে তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়,এমনকি তার কাজের সুযোগও বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
পরিবহন মালিকদের সাথে দর-কষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বাৎসরিক বোনাস এবং অন্যান্য সুবিধা আদায়ে ইউনিয়ন ব্যর্থ বলে মনে করেন শ্রমিকরা। তাদের অভিযোগ, নেতারা মালিকপক্ষের সাথে আঁতাত করে শ্রমিকদের স্বার্থ বিকিয়ে দেন।
বারবার আবেদন-নিবেদন করেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে সাধারণ শ্রমিকরা এখন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। তারা অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে কঠিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। শ্রমিকরা জানিয়েছেন ইউনিয়নের আয়-ব্যয়ের সম্পূর্ণ হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। কল্যাণ তহবিলে কত টাকা জমা আছে এবং তা কাদের জন্য খরচ হয়েছে, তার শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
যে সকল নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাদের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। একটি স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি তাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া না হয়, তাহলে তারা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন। এর মধ্যে কর্মবিরতি, বিক্ষোভ সমাবেশ এবং সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচিও থাকতে পারে।
একজন প্রবীণ ট্রাকচালক ক্ষোভের সাথে বলেন, “আমরা নেতাদের বানিয়েছি আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য, তাদের পকেট ভরার জন্য নয়। যদি সম্মান থাকতে তারা সরে না দাঁড়ান, তাহলে আমরা তাদের টেনেহিঁচড়ে নামাতে বাধ্য হব। এই ইউনিয়ন কোনো ব্যক্তির নয়, এটা সকল শ্রমিকের।
এই অভিযোগগুলোর বিষয়ে কথা বলার জন্য ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা এই অভিযোগগুলোকে ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাবি করেছেন। তার মতে, একটি প্রতিপক্ষ গোষ্ঠী ইউনিয়নের সুনাম নষ্ট করার জন্য সাধারণ শ্রমিকদের উস্কে দিচ্ছে।
পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অচলাবস্থা দ্রুত নিরসন করা না গেলে এর প্রভাব কুষ্টিয়ার সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়তে পারে।
শ্রমিকরা যদি একযোগে কর্মবিরতিতে যান, তাহলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সকল প্রকার মালামাল পরিবহন বন্ধ হয়ে যাবে, যা একটি মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করবে।
তাদের মতে, বাংলাদেশ সড়ক, পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং স্থানীয় জেলা প্রশাসনের উচিত দ্রুত হস্তক্ষেপ করে একটি নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা। উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করে ইউনিয়নের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
কুষ্টিয়া ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের খেটে খাওয়া শ্রমিকদের কান্না ও ক্ষোভ প্রমাণ করে যে, তাদের আস্থার জায়গাটি নড়বড়ে হয়ে গেছে। যে সংগঠন তাদের রক্ষা করার কথা, সেটিই যদি ভক্ষকের রূপ নেয়, তবে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। এই পরিস্থিতিতে, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত ক।